আমাদের মাঝের বিশাল সংখ্যক মানুষ রক্ত দান করে থাকেন। হুটহাট জরুরী প্রয়োজনে রক্তের দরকার পরে আমাদের, আর তাই অন্যের জীবন রক্ষার্থে কিছু মানুষ কোনরকম চিন্তাভাবনা না করেই রক্ত ডোনেট করে। কিন্তু আপনি কি জানেন, রক্ত দিলে কি কি ক্ষতি হয়! নাকি কখনো চিন্তাই করেননি যে রক্ত দেওয়ার ফলে কোন প্রকার ক্ষতি হলেও হতে পারে!
যারা স্বাস্থ্য সচেতন এবং এ বিষয়ে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন তাদের জন্যই মূলত আমাদের আজকের এই নিবন্ধনটি। আজ আমরা আপনাদেরকে জানাবো— রক্ত দিলে কি কি ক্ষতি হয়? রক্ত কারা দিতে পারে আর কারা রক্ত দেওয়া থেকে বিরত থাকবে, একজন মানুষ রক্ত দেওয়ার পর করনীয় কি, নিয়মিত রক্তদান করলে কেমন ঝুঁকির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, এতে কি কোন ক্ষতি হয় নাকি উপকার পাওয়া যায় ইত্যাদি বিষয়ে খুঁটিনাটি।
আরও পড়ুনঃ রক্তদান | রক্তদানের উপকারিতা
রক্ত দিলে কি কি ক্ষতি হয়?
একজন সুস্থ মানুষ যদি সঠিক নিয়ম মেনে রক্তদান করে তাহলে তার মূলত কোন জটিল ক্ষতি হয় না। তবে যাদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা খুবই কম তারা যদি রক্ত দিয়ে থাকে, তাহলে তাদের শারীরিক কিছু সমস্যা দেখা দেয়। আবার রক্তচাপ ও শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক না থাকলে ওই মুহূর্তে রক্ত দিলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে।
যাদের হাঁপানি বা অ্যাজমা অর্থাৎ শ্বাসকষ্ট জনিত রোগ রয়েছে তাদের রক্ত অন্যের শরীরে প্রয়োগ করলেও এতে সমস্যা হয় এবং যে রক্ত দিয়ে থাকে তারও কিছু সমস্যা দেখা দেয়। আবার যাদের টাইফয়েড, ডায়াবেটিস, চর্মরোগ, বাতজ্বর, হৃদরোগ রয়েছে তাদেরও রক্ত দেওয়া উচিত নয়। কেননা এ সকল রোগে আক্রান্ত মানুষ রক্ত দিলে সুস্থ মানুষের শরীরেও এই সমস্যাগুলো হবার সম্ভাবনা বাড়ে।
আবার যাদের বিগত ছয় মাসের মধ্যে কোন প্রকার দুর্ঘটনা বা অস্ট্রোপ্রচার করা হয়েছে তারাও মূলত রক্তদানের জন্য উপযুক্ত নয়। পাশাপাশি যে সকল মানুষ দীর্ঘদিন যাবত ঔষধ সেবন করছেন। যেমন ধরুন, কেমোথেরাপি, অ্যান্টিবায়োটিক হরমোন থেরাপি ইত্যাদি। সে সকল মানুষেরও রক্ত দেওয়া উচিত নয়।
রক্ত দেওয়ার পর করণীয়
আমরা ইতোমধ্যে রক্তদানের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরেছি অর্থাৎ কাদের শরীর থেকে রক্ত নেওয়া উচিত নয় এটা নিশ্চয়ই আপনাদের কাছে সুস্পষ্ট। এবার আসুন জেনে নেই একজন মানুষের কাছ থেকে রক্ত নেওয়ার পর সেই রক্তদাতার করণীয় কাজ কি?
শরীর থেকে যখন রক্ত বের করে নেওয়া হয় তখন মানুষ কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে– রক্তদানের পরবর্তী সময়ে সামান্য মাথা ঘোরায়। আর তাই এ সময় দ্রুত হাঁটাচলা না করে অন্তত এক থেকে দুই ঘন্টা বিশ্রাম নেওয়া অতিব জরুরী। আবার কিছু রক্তদাতা রক্ত দেওয়ার পরবর্তীতে প্রচুর পরিমাণে ঘেমে যান কেউ কেউ অস্থিরতা বোধ করেন। যদি এমনটা হয়ে থাকে তাহলে তাকে স্যালাইন খাওয়ানো উচিত।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ প্রত্যেকবার ৪৫০ মিলিলিটার রক্ত দান করতে পারেন। এর থেকে বেশি রক্ত নিলে কিছু শারীরিক সমস্যা হতে পারে। কেননা রক্ত নেওয়ার পর লোহিত রক্ত কণিকার মাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে প্রায় এক থেকে দেড় মাস সময় লেগে যায়। আর এজন্য রক্ত দেওয়ার পরবর্তীতে সেই রক্তদাতার অবশ্যই পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া জরুরী আর এমনটাই নির্দেশনা দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা।
আরও পড়ুনঃ শরীর শুকিয়ে যাওয়ার কারণ
রক্তদানকারীর খাবারের তালিকা
রক্তদানকারীর খাবারের তালিকায় মূলত এমন খাবার রাখতে হবে যেগুলো আমাদের শরীরে দ্রুত রক্তকে বৃদ্ধি করতে পারবে। এটা শুধু রক্তদানকারী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে নয়, যারা রক্তস্বল্পতায় ভোগেন তাদের জন্যও কার্যকরী খাবার। তাই এ পর্যায়ে আমরা খাবারের একটি চার্ট তুলে ধরব, যে খাবারগুলো মিলেমিশে একজন মানুষের অবশ্যই খাওয়া উচিত। যথা:-
- সবুজ শাকসবজি, যেগুলোতে রয়েছে ভিটামিন বি এবং ভিটামিন সি।
- আঙ্গুর, গাজর কমলা ইত্যাদি ফলমূল
- ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার যেমন লেবু, স্ট্রবেরি বা টক জাতীয় যেকোনো ফল
- ভিটামিন বি৯ এবং ভিটামিন বি ১২ সমৃদ্ধ খাবার
- আইরন সমৃদ্ধ খাবার সহ প্রভৃতি।
তাই রক্ত দান করার পরবর্তীতে অবশ্যই আপনি পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার খাদ্য তালিকায় রাখার চেষ্টা করবেন। এতে করে দ্রুত আপনার শরীরের রক্তের ঘাটতি পূরণ হয়ে যাবে এবং আপনি এক থেকে দেড় মাস পর আবারও রক্তদান করতে পারবেন।
এবার আসুন জেনে নিন- কে কাকে রক্ত দিতে পারবে। অর্থাৎ কোন রক্তের গ্রুপ কোন গ্রুপের রক্তের সাথে মিক্স হলে কোন সমস্যা বা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে না। আরও দেখুনঃ জেনে নিন- লিভার রোগীর খাদ্য তালিকা এবং লিভার ভালো রাখার ব্যায়ামসমূহ।
রক্ত নেওয়ার পূর্বে কি কি লক্ষ্য রাখা জরুরী?
একজন রক্তদাতার কাছ থেকে রক্ত নেওয়ার পূর্বে অবশ্যই বেশ কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। আমরা দ্রুত রক্ত লাগার ফলে অনেক সময় সব বিষয় না ভেবে রোগীর শরীরে রক্ত দিয়ে থাকি। চিকিৎসকরা নিজেদের মতামত প্রকাশ করলেও কখনো কখনো আমরা অতিরিক্ত টেনশনে ভুল সিদ্ধান্ত নেই যেটা রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর তাই রক্ত নেওয়ার আগে কি কি দেখবেন সেগুলো এ পর্যায়ে আমরা অতি সংক্ষেপে আলোচনা করব।
প্রথমত- রক্ত নেওয়ার জন্য আপনাকে গ্রহীতার সঙ্গে রক্তদাতার রক্তের গ্রুপের মিল রয়েছে কিনা সেটা নিশ্চিত হতে হবে। আনুমানিকের উপর ভিত্তি করে অবশ্যই রোগীর শরীরে অন্য কোন মানুষের রক্ত প্রবেশ করানো উচিত নয়।
এরপর রোগীকে রক্ত দেওয়ার আগে রক্তদাতার রক্তের কম্পোসিটের মিল রয়েছে কিনা সেটাও দেখতে হবে। শুধুমাত্র গ্রুপ মিলে গেলেও আমরা রোগীর শরীরে রক্ত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারি না, যদি না দুজনের শরীরের রক্তের কম্পোসিট এর মিল থাকে। অন্যদিকে কোন ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত নেওয়ার সময় অবশ্যই অবশ্যই রক্তের নম্বর খেয়াল রাখতে হবে। মানে আপনি যে রক্তটি রোগীকে পুশ করবেন বলে নিচ্ছেন সেটা কত তারিখের এবং আদৌ মেয়াদ রয়েছে কিনা।
আরও পড়ুনঃ শরীর দুর্বল হলে কি কি সমস্যা হয়
ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও রক্তের কম্পনেন্ট ফর্ম ভালো করে চেক করে নেবেন। পাশাপাশি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় রক্ত নিয়ে যাওয়ার সময় একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় রাখা অতীব জরুরী। মনে রাখবেন- সাধারণত ২০ থেকে ৬০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রক্ত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া উচিত। যদি তাপমাত্রা এর থেকে বেশি হয় তাহলে রক্ত এক জায়গা থেকে অন্য স্থানে পরিবহন করা ঠিক নয়। তাই অবশ্যই এই দিকগুলো মাথায় রাখুন এবং মেনে চলার চেষ্টা করুন। এবার আসুন আলোচনার শেষ মুহূর্তে জেনে নেই একজন মানুষ যদি নিয়মিত রক্তদান করে থাকে তাহলে তার কি কি রোগের ঝুঁকি কমে যায়!
১. ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে
২. রক্তস্বল্পতা পূরণ হয় এবং অস্থিমজ্জা সক্রিয় থাকে
৩. নিয়মিত রক্ত দিলে রক্তে জমে থাকা কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে
৪. রক্তদান করার ফলে জন্ডিস ম্যালেরিয়া এইচআইভি ইত্যাদি রোগ রয়েছে কিনা সেটা সম্পর্কে অবগত হওয়া যায় কেননা চিকিৎসকরা রক্ত দেওয়ার সময় রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সেটা রোগের জন্য কার্যকরী কিনা তা যাচাই বাছাই করেন।
সেই সাথে নিয়মিত রক্ত দিলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যেহেতু রক্তদান একটা মহৎ কাজ রক্তদান করার মাধ্যমে একজন মানুষের প্রাণ বেঁচে যায় তাই আসুন আমরা যার যার মতো এ কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং অন্যদেরকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। তো পাঠক বন্ধুরা আমাদের আজকের আলোচনা এ-পর্যন্তই। সবাই ভাল থাকবেন সুস্থ থাকবেন। খুব শীঘ্রই আবারও নতুন টপিকের নতুন কোন আলোচনায় আপনাদের সাথে কথা হবে। সবাইকে আল্লাহ হাফেজ।
আরও দেখুনঃ