বিশ্বজুড়ে রক্তদান এখন এক আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। আর তাইতো প্রত্যেক বছর জুন মাসের ১৪ তারিখে, বিশ্ব রক্তদাতা দিবস উদযাপন করা হয়। হর হামেশাই আমাদের আশেপাশের প্রতিবেশী আপনজনদের শারীরিক নানা জটিলতায় রক্তের প্রয়োজন পরে। আর তাই সেই মুহূর্তে প্রয়োজন পরে রক্ত ডোনারের, যাদের থেকে খুব সহজেই একই গ্রুপের রক্ত সংগ্রহ করা যায়।
রক্তদান এটি একটি মহৎ কাজ, যে কাজটি করার মাধ্যমে একটা প্রাণকে পুনরায় সুস্থ ও সুন্দরভাবে বাঁচার সুযোগ করে দেয়। আজকের এই আলোচনায় আমরা আপনাদেরকে রক্তদান কি এবং রক্তদানের উপকারিতা, সেইসাথে রক্তদান সম্পর্কে ইসলামি কিছু বিধি-বিধান তুলে ধরব, যেগুলো সম্পর্কে জানার জন্য সচরাচর অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেন।
আরও পড়ুনঃ শরীর শুকিয়ে যাওয়ার কারণ
রক্তদান কি?
রক্তদান হলো একটি পদ্ধতি, যে পদ্ধতির মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার রক্ত অন্য একজন সহকর্মীকে বাঁচাতে নিজ ইচ্ছায় দিয়ে থাকে। আরেকটু ভিন্নভাবে বললে বলা যায়– রক্তদান হলো কোন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়ার একটা প্রক্রিয়া।
রক্তদান কাকে বলে?
রক্ত পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্লাড ব্যাংকে সংরক্ষণ করে রাখার উদ্দেশ্যে যারা সদিচ্ছায় নিজেদের শরীরের রক্ত দান করে থাকে তাকেই রক্তদান বলা হয়। রক্তদান করলে সেই রক্তগুলো সাধারণ মানুষ বা যেকোনো রোগী প্রয়োজনের সময় ব্লাড ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করতে পারে, যেটা রোগীর প্রাণ বাঁচানোর কাজে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
রক্তদানের জন্য উপযুক্ত কারা?
ইতোমধ্যে আমরা রক্তদান কি সে সম্পর্কে জেনেছি। এখন কথা হচ্ছে- সবাই কি রক্ত দিতে পারবে? রক্তদানের জন্য মূলত উপযুক্ত প্রার্থী কারা? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়- যে সকল ব্যক্তিরা সুস্থ এবং শরীরে কোন প্রকার ভাইরাসজনিত রোগ নেই এবং যাদের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর বা তার বেশি তারাই হলো রক্তদানের জন্য উপযুক্ত প্রার্থী। আর এই রক্তদানের ক্ষেত্রে মূলত কিছু বিষয় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেগুলো হলো-
- আপনি যদি গত তিন মাসে কোন ঔষধ বা স্টেরয়েড সেবন করেন তাহলে রক্ত দিতে পারবেন না। অর্থাৎ আপনাকে রক্তদানের জন্য অযোগ্য বলে গণ্য করা হবে।
- এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত প্রার্থীরা রক্ত দিতে পারবেন না
- হেপাটাইটিস বা ক্ষতিকর ভাইরাস জনিত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা রক্তদানের ক্ষেত্রে অযোগ্য বলে গণ্য হবেন।
এর পাশাপাশি যারা শারীরিকভাবে অতিরিক্ত দুর্বল এবং বয়স অনেক কম তাদেরকেও মূলত রক্ত দানের ক্ষেত্রে রিজেক্ট করা হয়। তবে হ্যাঁ, এ-বিষয়ে যদি আরো ক্লিয়ার ধারণা পেতে চান তাহলে আপনি চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন।
রক্তদানকারীকে কি বলা হয়?
যে বা যারা রক্তদান করে থাকে তাদেরকে রক্তদাতা বা ব্লাড ডোনেটর বলা হয়ে থাকে। আর এজন্যই তাদেরকে সম্মাননা জানিয়ে ওয়ার্ল্ড ব্লাড ডোনার ডে উদযাপন করা হয়। যাতে করে রক্তদানের ক্ষেত্রে মানুষ সচেতন হতে পারে এবং সচেতনতা আরও বেশি বৃদ্ধি করতে পারে।
বিশ্ব রক্তদাতা দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো- গোটা বিশ্বের মানুষকে রক্তদানের ব্যাপারে সচেতন করে তোলা, উদ্বুদ্ধ করা মানুষের মাঝে সংহতি এবং সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি করা। পাশাপাশি মানুষের মনের অহেতুক ভয়কে দূর করা এবং নতুন রক্তদাতা তৈরি করা এবং নিরাপদ রক্ত ব্যবহারে উৎসাহিত করা। তাই আসুন দেশের দশের উপকারের জন্য আমরা নিজ নিজ দায়িত্বে রক্তদান করি এবং অন্যকেও এ ব্যাপারে জানাতে এগিয়ে আসি।
রক্তদান করার কারণ কি?
রক্তদান করার মাধ্যমে অন্যের জীবন বাঁচানোতে বিশেষ ভূমিকা রাখা যায়। রক্তদান করার মূলত অন্যতম এবং একমাত্র কারণ কোন দুর্ঘটনায় কবলিত বা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রয়োজনের সময় রক্ত দিয়ে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
আমাদের শরীরে রক্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, আর এটা আমাদের কারোরই অজানা নয়। শরীরের অন্যান্য সমস্ত কাজের জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখে রক্ত। আমাদের শরীরে যদি এক ফোঁটা রক্ত না থাকে তাহলে আমাদের এই জীবন শেষ হয়ে যাবে অর্থাৎ আমরা বাঁচতে পারব না।
আর কিছু পরিস্থিতিতে মূলত মানুষের দেহে রক্তের অভাব দেখা দেয়। আর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি শরীরে রক্ত স্থানান্তর করা না হয় তাহলে ওই ব্যক্তি জীবন হারাতে পারে। কিন্তু সঠিক সময়ে রক্ত স্থানান্তর করতে পারলে সেই ব্যক্তির জীবন বেঁচে যেতে পারে আল্লাহর রহমতে। আর এজন্যই মূলত রক্তদান করা হয়। যাতে করে দুরারোগ্য বা রক্তশূন্য ব্যক্তিকে সঠিক সময়ে রক্ত দেওয়ার মাধ্যমে তার চিকিৎসা করা যায় এবং তাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়।
রক্তদানের ধরন কয়টি ও কি কি?
রক্তদানের ধরন চারটি। বলতে পারেন স্বেচ্ছায় রক্তদান মূলত চার প্রকার। যথা:-
- পরিপূর্ণ রক্তদান
- প্লেট লেট দান
- প্লাজমা দান এবং
- লাল রক্ত কণিকা দান
এবার আসুন জেনে নেই আপনি কেন রক্ত দান করবেন, রক্তদানে উপকৃত হওয়ার কি কোন সম্ভাবনা রয়েছে না কি নেই? আর যদি থেকে থাকে তাহলে সেই সকল উপকারিতা গুলো কি কি!
রক্তদানের উপকারিতা
রক্তদানের উপকারিতা অনেক। আর এর অন্যতম উপকার হিসেবে আমরা তুলে ধরতে পারি দানকৃত রক্ত আরেকজন মানুষের জীবন বাঁচিয়ে দেয়। রক্তদানে শুধুমাত্র যে অসুস্থ সেই মানুষটি উপকৃত হয় এমনটা নয়। রক্তদান করার মাধ্যমে রক্তদানকারী ব্যক্তিও বেশ কিছু উপকার পেয়ে থাকেন। যেমন:
- তার শরীরে নতুন লাল রক্ত কণিকার বিকাশ ঘটে
- হৃদ রোগের ঝুঁকি কমে যায়
- ক্যালোরি বার্ন করে
- আয়রনের মাত্রা কমে যায় (কিছু লোকের উৎস আয়রনের মাত্রা উদ্বেগের সৃষ্টি করে তাদের জন্য উপকারী)
- মানসিক স্বস্তি মেলে এবং
- অন্যের মুখে হাসি ফোটানো যায় জীবন বাঁচানোর মাধ্যমে।
তাই আসুন আমরা নিজ নিজ দায়িত্বে রক্তদানের জন্য এগিয়ে আসি এবং নিজেদেরকে ও আশেপাশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করি। পাশাপাশি আলোচনার শেষ মুহূর্তে জেনে নেই- রক্তদান নিয়ে ইসলামি নিষেধ নির্দেশনা। আমাদের ধর্মে রক্তদান করার নির্দেশনা কি দেওয়া রয়েছে, নাকি এটা আমাদের জন্য নিষিদ্ধ!
রক্তদান নিয়ে ইসলামী বিধান
রক্তদানের ক্ষেত্রে ইসলাম কোন নিষেধ প্রদান করেনি। কেননা রক্ত মানুষের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুসর্গ, আর এটা প্রাণ বাঁচানোর জন্য দেওয়া হয়ে থাকে। অতএব সৃষ্টির কল্যাণে মানুষ রক্ত দান করছে এটা অবশ্যই ভালো কাজের মধ্যে পড়ে। আর এতে করে আমাদের মহান আল্লাহতালাও সন্তুষ্ট হন। তবে হ্যাঁ, আমরা যদি কোন কারণ ছাড়া অর্থাৎ আমাদের শরীরে কোন প্রয়োজন নেই তবুও অন্য কারো শরীর থেকে রক্ত নিজের শরীরে স্থানান্তর করি তাহলে সেটা হারাম বলে গ্রহণযোগ্য হবে। যেটা একজন মুসলিম হিসেবে করা একেবারেই উচিত নয়।
আর তাই রক্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। যেগুলো আমরা ধারাবাহিকভাবে এ পর্যায়ে তুলে ধরবো। তাহলে আসুন জেনে নেই- রক্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মূলত কোন বিষয়গুলো অবশ্যই মনে রাখা জরুরী!
✓ যখন কোন ব্যক্তি অসুস্থ এবং তার জীবননাশের আশঙ্কা রয়েছে সেই মুহূর্তে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে বাঁচানোর তাগিদে আপনি রক্ত দান করতে পারেন। আর এমনটা করার উৎসাহ ইসলাম সর্বদা দিয়ে এসেছে।
✓ রক্ত দেওয়া প্রয়োজন, রক্ত দিলে সেই ব্যক্তিটি তার সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাবে অথবা তার শরীরে যদি কোন রোগ বাসা বেধে থাকে তাহলে সেই ঝুঁকি অনেকটা কমে যাবে এমন অবস্থাতেও রক্ত দেওয়া জায়েজ।
✓ যদি কোন ব্যক্তির শরীরে রক্ত দেওয়ার জন্য অধিক বেশি প্রয়োজন দেখা না দেয় অর্থাৎ রক্ত না দেওয়ার অবকাশ থেকে থাকে তাহলে অযথা রক্ত দেওয়া ইসলাম সমর্থ করে না এটা হারাম বলে গ্রহণযোগ্য।
✓ যখন জীবন নাশের এবং অসুস্থতা বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না বরং শুধুমাত্র শক্তি বৃদ্ধি বা সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্দেশ্যে শরীরে রক্ত দেওয়া হয় সে ক্ষেত্রেও ইসলাম রক্ত দেওয়াকে নাজায়েজ করে দেয়। সুতরাং ওই মুহূর্তেও আমাদের রক্ত দেওয়া ঠিক হবে না।
অনেকেই জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন, রক্ত কেনা অথবা বিক্রি করা কি আমাদের ইসলাম ধর্ম সমর্থন করে? এ প্রশ্নের উত্তর হবে “না”। আমাদের ধর্মে রক্ত ক্রয় বিক্রয় জায়েজ নয়। কিন্তু আমরাই আপনাদেরকে ইতোমধ্যে যে চারটি কারণ তুলে ধরেছি এর মধ্যে প্রথম দুইটি কারণে অর্থাৎ রোগীর জন্য খুবই রক্তের প্রয়োজন কিন্তু ওই মুহূর্তে আপনি বিনা টাকায় রক্ত পাচ্ছেন না সে ক্ষেত্রে কিনতে পারবেন। তবে যে টাকার বিনিময়ে রক্ত দিয়ে থাকবে অর্থাৎ যে রক্তের মূল্য নিচ্ছে সেটা তার জন্য জায়েজ হবে না।
আরও দেখুনঃ