সমাজে প্রচলিত ক্ষতিকর রীতিনীতি প্রথা, সামাজিক কুসংস্কার বা মূল্যবোধ, যেগুলো সমাজের জন্য অমঙ্গলজনক বলে বিবেচিত তা অপসারণ করার উদ্দেশ্যে যে পরিবর্তন আনা হয় তাই হচ্ছে সমাজ সংস্কার। সমাজ সংস্কার বলতে কী বোঝায়, সমাজ সংস্কারের বৈশিষ্ট্য এবং সমাজ সংস্কার মূলক কাজ সম্পর্কে জানতে পরবর্তী অংশ পড়ুন।
ভূমিকা
মানবসভ্যতার ইতিহাসে সমাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যেখানে মানুষ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে, নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে জীবনযাপন করে। তবে সমাজ সবসময়ই নিখুঁত ছিল না। সময়ের পরিবর্তনে সমাজে অনেক অনাচার, কুসংস্কার, বৈষম্য ও অন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব অন্যায়, কুশিক্ষা ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে যে পরিবর্তন বা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়, তাকেই সমাজ সংস্কার বলে।
আমরা যদি একটু লক্ষ্য করি তাহলে চোখে পড়বে– আমাদের সমাজে অশিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেশি। তাই স্বাভাবিকভাবে তাদের দ্বারা কুসংস্কার সৃষ্টি হয় থাকে বেশি বেশি। তাছাড়াও মানুষ সামাজিক প্রাণী, তারা সমাজে বাস করতে গিয়ে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রভাবে আচ্ছাদিত হয়।
ফলে কিছু অকল্যাণকর দিক তাদেরকে গ্রাস করে এবং সেই দিকগুলো দূর করতে সমাজকে সংস্করণের প্রয়োজন পড়ে। মূলত সমাজকে সুন্দর, মানবিক এবং ন্যায়নিষ্ঠ করে তোলার প্রচেষ্টা চালানো হয়, আর একেই বলা হয় সমাজ সংস্কার।
সমাজ সংস্কারের পরিচয়
সমাজ সংস্কারের কতিপয় ডিকশনারি ও মনীষীদের সংজ্ঞা আলোকপাত করলে আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে সমাজ সংস্কারের পরিচয়। সহজভাবে বলতে গেলে– সমাজ সংস্কার হলো সমাজের কুপ্রথা, কুসংস্কার, অসাম্য, এবং অন্যায় আচরণকে দূর করে ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও প্রগতিশীল সমাজ গঠনের প্রয়াস।
এটি মূলত একটি চিন্তাগত ও কার্যকর পরিবর্তন যা সমাজের গঠন ও দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে দিতে সাহায্য করে। সমাজ সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য হলো: মানুষের মাঝে শিক্ষা, নৈতিকতা ও মানবিকতা ছড়িয়ে দেওয়া, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, জাতপাত ও বর্ণবাদের অবসান, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি সহ প্রভৃতি।
সমাজ সংস্কারের সংজ্ঞা
✓The Social Work Dictionary এর মতে: “সমাজ সংস্কার হলো সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নির্ধারিত ভূমিকা, সামাজিক আচরণের ধরন প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাঞ্ছিত পরিবর্তনের সুচিন্তিত ও উদ্দেশ্যপূর্ণ কার্যক্রম।”
✓ New Standard Encyclopedia এর মতে: “সমাজ সংস্কার হলো এমন একটি কার্যক্রম, যা সামাজিক মূল্যবোধ, সামাজিক আইন এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সামাজিক শ্রেণি অথবা সমগ্র সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচালিত।”
সমাজ সংস্কারের বৈশিষ্ট্য
Encyclopedia of social work in India এর মতে, সমাজসংস্কারের ৪টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে । সেগুলো হলো–
- সমাজসংস্কার সামাজিক মনোভাব সৃষ্টিকারী প্রক্রিয়া।
- এটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধের মৌলিক পরিবর্তন সূচিত করে।
- সমাজ সংস্কার এক ধরনের প্রত্যাশিত অবস্থান যা জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে সহায়ক এবং
- সমাজসংস্কার কেবল সমাজের ক্ষতিকর দিকেরই পরিবর্তন আনতে চায়, পুরো সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন সমাজসংস্কারের লক্ষ্য নয়।
এছাড়াও অন্যান্য আরো কিছু বিষয়ের উপর ভিত্তি করে সমাজ সংস্কারের কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো:
- সমতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা
- আইনি পরিবর্তন প্রণয়ন
- নৈতিক মূল্যবোধের প্রচার
- মানব কল্যাণ প্রণয়ন এবং কুসংস্কার দূরীকরণ বলক কার্যক্রম গ্রহণ।
আরও পড়ুনঃ বিক্রয় কাকে বলে ও মুক্তপেশা কাকে বলে
সমাজ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা
সমাজ সংস্কারের একাধিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আমরা জানি, সামাজিক কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত সামাজিক পরিবর্তই হল সমাজ সংস্কার। সমাজে প্রচলিত ক্ষতিকর রীতিনীতি প্রথা, প্রতিষ্ঠান, মূল্যবোেধ যেগুলো সমাজের জন্য অমঙ্গলজনক বলে বিবেচিত সেগুলো অপসারণ করে তার স্থলে মঙ্গলজনক রীতিনীতি, প্রথা, প্রতিষ্ঠান, মূল্যবোধ প্রভৃতি স্থাপন বা পরিবর্তন আনয়নকেই সমাজ সংস্কার বলা হয়।
আর সমাজ সংস্কারের প্রধান প্রয়োজনীয়তা গুলো বিদ্যমান রয়েছে
- কুসংস্কার দূরীকরণে
- সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায়
- মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়ন ও শিক্ষার প্রসারের
- আধুনিকতায় এবং অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদসহ নৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে।
উপসংহার: মূলত সমাজ সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। কেননা যে কোন কাঙ্খিত পরিবর্তনের জন্য সামাজিক সংস্কারের প্রয়োজন হয়। আর তখনই বিশেষ আন্দোলন বা বিশেষ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।স্বাভাবিকভাবে যেহেতু সমাজে সবসময় কিছু না কিছু অসঙ্গতি থাকবেই। তাই আমাদের উচিত সেগুলোর বিরুদ্ধে সচেতন হওয়া এবং আমাদের সকলের একজোট হয়ে এগিয়ে আসা।
বলা যায় সমাজ সংস্কারকরা আমাদের পথপ্রদর্শক, যাদের আদর্শ অনুসরণ করে আমরা ন্যায়ের পক্ষে ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারি। যার মাধ্যমে আমাদের সমাজ হতে পারে মানবিক আধুনিক এবং প্রগতিশীল। কেবল একটা ইতিহাস নয় এটা মূলত বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয় বস্তু, যার মাধ্যমে একটি অসামঞ্জস্য আইন উপড়ে ফেলা হয় এবং নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়, যা আমাদের সকলের জন্য মঙ্গলজনক।
জিজ্ঞাসিত প্রশ্নোত্তর
১. সমাজ সংস্কার মূলক কাজ কি কি?
✓ সমাজ সংস্কার মূলক কাজের অন্তর্ভুক্ত বিষয় হচ্ছে–
- বাল্যবিবাহ রোধ, নারী শিক্ষার প্রসার, বিধবা পুনর্বিবাহ প্রচলন, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, যৌতুক প্রথা প্রতিরোধ এবং অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, দারিদ্র দূরীকরণ ও শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন সহ প্রভৃতি।
২. সমাজ সংস্কার আন্দোলন কি?
✓ বহুল জিজ্ঞাসিত একটি প্রশ্ন হচ্ছে সমাজ সংস্কার আন্দোলন বলতে কী বুঝ! সংক্ষেপে বলতে গেলে বিষয়টি দাঁড়ায়– সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার, অন্যায় প্রথা ও অপব্যবস্থার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করে তা পরিবর্তনের লক্ষ্যে সংগঠিত প্রচেষ্টা বা আন্দোলনকে সমাজ সংস্কার আন্দোলন বলে। উদাহরণস্বরূপ, সতীদাহ প্রথা বিরতি আন্দোলন এবং সম্প্রতি সময়ের ছাত্র আন্দোলনের বিষয়টি ধরা যেতে পারে।
৩. সামাজিক আন্দোলন কাকে বলে?
✓ সামাজিক পরিবর্তন আনোনয়নের লক্ষ্যে সকলে একজোট হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সংগঠিত একটি একনিষ্ঠ প্রচেষ্টাকে সামাজিক আন্দোলন বলা হয়। এই আন্দোলনের গঠনমূলক উদ্দেশ্য থাকে, জনগণ অংশগ্রহণ করে এবং সমাজের পরিবর্তন বা প্রতিরোধের জন্য সকলে একজোট হয়ে কাজ করে।
৪. কয়েকজন সমাজ সংস্কারক এর নাম লিখ
✓ সমাজ সংস্কারকের তালিকায় অনেকেই রয়েছেন। তবে ইতোমধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি পরিচিত মুখ তারা হলেন–
- রাজা রামমোহন রায়
- স্বামী বিবেকানন্দ
- মহাত্মা গান্ধী
- ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
- বেগম রোকেয়া
- ড. বি. আর. আম্বেদকর সহ প্রভৃতি।
৫. সামাজিক আইন ও সমাজ সংস্কার পরস্পর সম্পর্কিত বুঝিয়ে লেখ
✓ সামাজিক আইন এবং সমাজ সংস্কার একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। সমাজে পরিবর্তন আনার জন্য এ দুটি উপাদান একসঙ্গে কাজ করে। নিচে অতি সংক্ষেপে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হলো।
সামাজিক আইন: সামাজিক আইন হলো রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত এমন নিয়ম-কানুন ও বিধান, যা সমাজে ন্যায়বিচার, সাম্য ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য তৈরি করা হয়। এর মাধ্যমে সমাজের মানুষদের নির্দিষ্ট আচরণে অভ্যস্ত করা হয় এবং অন্যায় ও অবিচার প্রতিরোধ করা হয়। উদাহরণ: বাল্যবিবাহ-নিরোধ আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন।
সমাজ সংস্কার: সমাজ সংস্কার হলো সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার, অমানবিক রীতি ও পুরনো চিন্তাধারাকে পরিবর্তন করে নতুন, উন্নত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা। এটি সাধারণত সমাজচিন্তক, নেতা বা শিক্ষিত মানুষদের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়। উদাহরণ: রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার জন্য আন্দোলন করেন।
এখন যদি সামাজিক আইন ও সমাজ সংস্কারের পারস্পরিক সম্পর্ক চিন্তা করি তাহলে বিষয়টি এমন দাঁড়াবে–
- সমাজ সংস্কার আইন প্রণয়নের পথ প্রস্তুত করে।
- আইন সমাজ সংস্কার কে বাস্তবায়ন করে
- উভয়ে সমাজে উন্নয়নের জন্য কাজ করে এবং সংস্কার ছাড়া আইন নিষ্ক্রিয় এমনকি আইন ছাড়া সংস্কার অসম্পূর্ণ।
এক কথায়, সামাজিক আইন সমাজে নেয় ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে আর সমাজ সংস্কার সামাজিক আইনকে বাস্তবায়নের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে।
৬. সমাজকর্মের সাথে সমাজ সংস্কারের সম্পর্ক আলোচনা কর
✓ আমরা জানি যে সমাজকর্ম হলো একটি পেশাগত ও মানবিক কার্যক্রম, যার মাধ্যমে ব্যক্তিগত পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধানের সহায়তা প্রদান করা হয়। সমাজকর্মের মূল লক্ষ্য হলো সমাজে সাম্য, ন্যায়বিচার ও কল্যাণ নিশ্চিত করা।
অপরদিকে সমাজ সংস্কার হচ্ছে সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার, বৈষম্য অবিচার ও অনৈতিক প্রথা দূর করার জন্য সকলে একজোট হয়ে সচেতন ও সংগঠিত পদক্ষেপ গ্রহণ। সংস্কারকরা সমাজের কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি উন্নত ও মানবিক সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা চালায়।
এদের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যদি আপনি সমাজ কর্ম এবং সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্য লক্ষ্য করেন তাহলে নজরে আসবে– এদের উভয়ের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের কল্যাণ ও সমাজের উন্নয়ন করা। এখানে সমাজকর্ম ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সমস্যার সমাধান করে অন্যদিকে সমাজ সংস্কার বৃহত্তর সামাজিক অবিচার দূর করে।
শুধুমাত্র এদের মধ্যে কার্যপদ্ধতির পার্থক্য রয়েছে। যেমন সমাজকর্ম ব্যক্তি ও পরিবার ভিত্তিক কাজ করার মাধ্যমে সম্পাদিত হয় কিন্তু সমাজ সংস্কার সমাজে প্রচলিত অন্যায় রীতিনীতি দূর করার জন্য সকলে একজোট হয়ে কাজ করতে হয়।
অতএব সবশেষে বলতে পারি, সমাজকর্ম ও সমাজ সংস্কার একই লক্ষে পরিচালিত দুটি পৃথক কিন্তু পরস্পর নির্ভরশীল একটি প্রক্রিয়া। সমাজকর্ম বর্তমান সমস্যার সমাধানে কাজ করে কিন্তু সমাজ সংস্কার ভবিষ্যতের জন্য একটি উন্নত সমাজ গঠনের পথ তৈরি করতে সচেষ্ট থাকে। এরা মূলত একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে এটাই বলা বাঞ্ছনীয়।